তাদের বিশ্বাস অনুকরণ করুন | হনোক
“তিনি ঈশ্বরের প্রীতির পাত্র ছিলেন”
হনোক দীর্ঘসময় ধরে বেঁচে ছিলেন। আমাদের জন্য এটা কল্পনা করা কঠিন হতে পারে কিন্তু সেই ব্যক্তি প্রায় ৩৬৫ বছর—মানুষের বর্তমান আয়ুর চেয়ে চার গুণেরও বেশি সময়—বেঁচে ছিলেন! কিন্তু, তার সময়ের জগতে তিনি আসলে বৃদ্ধ ছিলেন না। সেই সময় অর্থাৎ ৫,০০০ বছরেরও বেশি সময় আগে লোকেরা বর্তমান সময়ের তুলনায় অনেক দীর্ঘসময় বেঁচে থাকত। যখন হনোকের জন্ম হয়, তখন প্রথম মানুষ আদমের বয়স ছিল ৬০০-রও উপরে আর এরপর আদম আরও ৩০০ বছর বেঁচে ছিলেন! আদমের বংশধরদের মধ্যে কেউ কেউ এর চেয়েও দীর্ঘসময় বেঁচে ছিলেন। তাই, ৩৬৫ বছর বয়স হওয়া সত্ত্বেও হনোক হয়তো দেখতে বেশ প্রাণবন্ত ছিলেন, মনে হয়েছিল যেন তার সামনে পুরো জীবন পড়ে রয়েছে। কিন্তু, সত্যি বলতে কী, তার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি।
হনোক হয়তো ঘোর বিপদের মধ্যে ছিলেন। কল্পনা করুন, তিনি ছুটে পালাচ্ছেন। সম্প্রতি, লোকেদের তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত এক বার্তা জানিয়েছেন আর সেই বার্তা শুনে তারা যে-প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তারা প্রচণ্ড রেগে যায় এবং তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। তারা তার বার্তা অবজ্ঞা করে এবং যে-ঈশ্বর তাকে পাঠিয়েছেন, তাঁকেও তুচ্ছ করে। হনোকের ঈশ্বর যিহোবাকে আক্রমণ করার ক্ষমতা তাদের নেই, কিন্তু এই ব্যক্তিকে তো আক্রমণ করতে পারে! সম্ভবত, হনোক মনে মনে ভাবছিলেন, তিনি হয়তো আর কোনোদিন তার পরিবারকে দেখতে পাবেন না। তিনি কি তার স্ত্রী ও মেয়েদের কথা অথবা তার ছেলে মথূশেলহ কিংবা তার নাতি লেমকের কথা চিন্তা করছিলেন? (আদিপুস্তক ৫:২১-২৩, ২৫) এটাই কি তার জীবনের শেষ?
বাইবেলের বিবরণে হনোকের চরিত্র কিছুটা রহস্যময়। বাইবেলের মাত্র তিনটে অংশে অল্পকথায় তার সম্বন্ধে বলা আছে। (আদিপুস্তক ৫:২১-২৪; ইব্রীয় ১১:৫; যিহূদা ১৪, ১৫) কিন্তু, সত্যি বলতে কী, সেই কয়েকটা পদের মাধ্যমেই এই ব্যক্তি সম্বন্ধে যথেষ্ট জানা যায়, যার গভীর বিশ্বাস ছিল। আপনাকে কি পরিবারের জন্য ভরণ-পোষণ জোগাতে হয়? আপনি কি কখনো সত্যের পক্ষসমর্থন করতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন? যদি এইরকমটা হয়ে থাকে, তা হলে আপনি হনোকের বিশ্বাস থেকে অনেক কিছু শিখতে পারেন।
“হনোক ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন করিতেন”
যখন হনোকের জন্ম হয়, তখন মানবজাতি খুবই মন্দ এক পথে চলছিল। তারা ছিল আদমের বংশের সপ্তম প্রজন্ম। তাই বোঝা যাচ্ছে, তারা মানবসিদ্ধতার একেবারে কাছাকাছি সময়ে বাস করছিল, যে-সিদ্ধতা একসময় আদম ও হবার ছিল কিন্তু পরে তারা তা হারিয়েছিলেন। এই কারণেই তখনকার লোকেরা এত দীর্ঘসময় বেঁচে থাকত। কিন্তু, নৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয় ছিল। চারিদিকে দৌরাত্ম্য ছেয়ে ছিল। এই প্রবণতা দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে শুরু হয়েছিল, যখন কয়িন তার ভাই হেবলকে হত্যা করেছিলেন। কয়িনের বংশধরদের মধ্যে একজন কয়িনের চেয়ে বেশি হিংস্র ও প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন আর এই বিষয়টা তিনি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে জাহির করেছিলেন! তৃতীয় প্রজন্ম থেকে এক নতুন মন্দতা শুরু হয়েছিল। লোকেরা “সদাপ্রভুর [“যিহোবার,” NW]” নামে ডাকতে আরম্ভ করেছিল কিন্তু শ্রদ্ধা সহকারে উপাসনার উদ্দেশ্যে নয়। স্পষ্টতই, তারা ঈশ্বরের পবিত্র নামকে নিন্দনীয় ও অসম্মানজনক উপায়ে ব্যবহার করছিল।—আদিপুস্তক ৪:৮, ২৩-২৬.
এই ধরনের কলুষিত উপাসনা সম্ভবত হনোকের দিনে খুবই সাধারণ ছিল। তাই, বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হনোককে একটা বাছাই করতে হয়েছিল। তিনি কি তার দিনের লোকেদের মতো হবেন? না কি তিনি সত্য ঈশ্বর যিহোবার অন্বেষণ করবেন, যিনি স্বর্গ ও পৃথিবী নির্মাণ করেছেন? তিনি নিশ্চয়ই হেবলের বিষয়ে জানতে পেরে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যিনি যিহোবাকে খুশি করে, এমন উপায়ে উপাসনা করার কারণে শহিদ হিসেবে মারা গিয়েছিলেন। হনোকও একইরকম অবস্থান গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আদিপুস্তক ৫:২২ পদ বলে: “হনোক . . . ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন করিলেন।” এই চমৎকার অভিব্যক্তি দেখায় যে, সেই অধার্মিক জগতে হনোক একজন ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি হলেন প্রথম ব্যক্তি, যার বিষয়ে বাইবেলে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
বাইবেলের সেই একই পদ জানায়, তার ছেলে মথূশেলহের জন্মের পরও হনোক ক্রমাগত যিহোবার সঙ্গে গমনাগমন করেছিলেন। তাই আমরা বুঝতে পারি, তিনি যখন পরিবার গঠন করেছিলেন, তখন তার বয়স ছিল ৬৫ বছর। পরিবারে তার স্ত্রী—যার নাম বাইবেলে উল্লেখ করা নেই—এবং বেশ কয়েক জন ‘পুত্ত্রকন্যা’ ছিল। একজন বাবাকে যদি পরিবারের দেখাশোনা করার ও ভরণ-পোষণ জোগানোর পাশাপাশি ঈশ্বরের সঙ্গে গমনাগমন করতে হয়, তা হলে তাকে অবশ্যই ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবারের যত্ন নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। হনোক বুঝতে পেরেছিলেন যে, যিহোবা চান যেন তিনি তার স্ত্রীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকেন। (আদিপুস্তক ২:২৪) আর নিশ্চিতভাবেই তিনি তার সন্তানদের যিহোবা ঈশ্বর সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়ার বিষয়ে যথাসাধ্য করেছিলেন। এর ফল কী হয়েছিল?
বাইবেল এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানায় না। এটি হনোকের ছেলে মথূশেলহের বিশ্বাস সম্বন্ধে কিছুই জানায় না, যিনি বাইবেলের নথি অনুযায়ী সবচেয়ে দীর্ঘসময় বেঁচে ছিলেন। তিনি যে-বছরে মহাজলপ্লাবন হয়েছিল, সেই বছর মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু, মথূশেলহ লেমক নামে এক পুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। লেমক জন্মগ্রহণ করার পর তার ঠাকুরদাদা হনোক ১০০ বছরেরও বেশি সময় বেঁচে ছিলেন। আর লেমক বড়ো হয়ে উল্লেখযোগ্য বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন। যিহোবা তাকে তার পুত্র নোহের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন আর এই ভবিষ্যদ্বাণী জলপ্লাবনের পর পরিপূর্ণ হয়েছিল। নোহও তার প্রপিতামহ হনোকের মতো ঈশ্বরের সঙ্গে গমনাগমন করেছিলেন। হনোকের সঙ্গে নোহের কখনো দেখা হয়নি। কিন্তু, হনোক এক চমৎকার নথি রেখে গিয়েছিলেন। নোহ হয়তো তার বাবা লেমকের অথবা তার ঠাকুরদাদা মথূশেলহের কিংবা হতে পারে হনোকের বাবা যেরদের কাছ থেকে সেই নথি সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলেন। আর নোহের বয়স যখন ৩৬৬ বছর, তখন যেরদ মারা গিয়েছিলেন।—আদিপুস্তক ৫:২৫-২৯; ৬:৯; ৯:১.
হনোক ও আদমের মধ্যে যে-পার্থক্য ছিল, সেটা নিয়ে চিন্তা করুন। আদম, যদিও সিদ্ধ ছিলেন, যিহোবার বিরুদ্ধে পাপ করেছিলেন এবং তার বংশধরদের জন্য বিদ্রোহী মনোভাব এবং দুর্দশার এক নথি রেখে গিয়েছিলেন। হনোক, যদিও অসিদ্ধ ছিলেন, ঈশ্বরের সঙ্গে গমনাগমন করেছিলেন এবং তার বংশধরদের জন্য বিশ্বাসের এক নথি রেখে গিয়েছিলেন। হনোকের বয়স যখন ৩০৮ বছর, তখন আদম মারা গিয়েছিলেন। আদমের পরিবার কি অত্যন্ত স্বার্থপর এই পূর্বপুরুষের জন্য শোক করেছিল? আমরা তা জানি না। যা-ই হোক না কেন, হনোক “ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন করিতেন।”—আদিপুস্তক ৫:২৪.
আপনাকে যদি পরিবারের জন্য ভরণ-পোষণ জোগাতে হয়, তা হলে হনোকের বিশ্বাস থেকে আপনি কী শিখতে পারেন, তা বিবেচনা করুন। যদিও পরিবারের দৈহিক বিষয়বস্তু জোগানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু আধ্যাত্মিক বিষয়বস্তু জোগানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না। (১ তীমথিয় ৫:৮) আর সেই চাহিদা আপনি কেবল কথার মাধ্যমে নয় কিন্তু কাজের মাধ্যমে পূরণ করতে পারেন। হনোকের মতো আপনিও যদি ঈশ্বরের সঙ্গে গমনাগমন করা বেছে নেন এবং জীবনে চলার পথে ঈশ্বরের মান অনুসরণ করেন, তা হলে আপনিও আপনার পরিবারের জন্য এক চমৎকার নথি—তাদের জন্য অনুকরণ করার মতো এক উত্তম উদাহরণ—রেখে যেতে পারবেন।
হনোক “লোকদের উদ্দেশে এই ভাববাণী বলিয়াছেন”
হনোক হয়তো এইরকম এক অবিশ্বস্ত জগতে একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে একা বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু, তার ঈশ্বর যিহোবা কি তাকে লক্ষ করেছিলেন? হ্যাঁ, তিনি লক্ষ করেছিলেন। একদিন যিহোবা তাঁর এই বিশ্বস্ত দাসের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ঈশ্বর হনোককে তার দিনের লোকেদের কাছে এক বার্তা জানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এভাবে যিহোবা হনোককে একজন ভাববাদী হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনিই হলেন প্রথম ভাববাদী, যার বার্তা বাইবেলে প্রকাশ করা হয়েছে। আমরা এই বার্তা সম্বন্ধে জানতে পারি কারণ a
অনেক শতাব্দী পরে যিশুর সৎভাই যিহূদা ঈশ্বরের অনুপ্রেরণায় হনোকের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক কথাগুলো লিখেছিলেন।হনোক কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন? তিনি বলেছিলেন: “দেখ, প্রভু [ঈশ্বর] আপন অযুত অযুত পবিত্র লোকের সহিত আসিলেন, যেন সকলের বিচার করেন; আর ভক্তিহীন সকলে আপনাদের যে সকল ভক্তিবিরুদ্ধ কার্য্য দ্বারা ভক্তিহীনতা দেখাইয়াছে, এবং ভক্তিহীন পাপিগণ তাঁহার বিরুদ্ধে যে সকল কঠোর বাক্য কহিয়াছে, তৎপ্রযুক্ত তাহাদিগকে যেন ভর্ৎসনা করেন।” (যিহূদা ১৪, ১৫) আপনি হয়তো প্রথম যে-বিষয়টা লক্ষ করেছেন, সেটা হল হনোক এখানে অতীত কালে কথা বলেছেন, যা পড়ে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা কথাগুলো ঈশ্বর ইতিমধ্যেই পরিপূর্ণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে এই পদ্ধতিই অনেক ভবিষ্যদ্বাণীতে অনুসরণ করা হয়েছে। ধারণাটা হল: ভাববাদী এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, যেটার পরিপূর্ণতা এতটাই নিশ্চিত যে, সেটা ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে বলে বর্ণনা করা যেতে পারে!—যিশাইয় ৪৬:১০.
সকলের কাছে প্রচার করার মাধ্যমে বার্তাটা জানানো হনোকের জন্য কেমন ছিল? লক্ষ করুন, সেই বার্তা কতটা জোরালো ছিল। লোকেদের, তাদের কাজ এবং তাদের কাজের ধরনকে নিন্দা করার জন্য সেই সাবধানবাণীতে “ভক্তিহীন” ও “ভক্তিবিরুদ্ধ” শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে ওই ভবিষ্যদ্বাণীতে সমস্ত মানুষকে সাবধান করা হয়েছিল যে, এদন বাগান থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে তারা যে-জগৎ গড়ে তুলেছিল, সেটা পুরোপুরিভাবে কলুষিত। সেই জগৎ এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে, যখন যিহোবা ধ্বংস নিয়ে আসার জন্য তাঁর “পবিত্র লোকের”—যুদ্ধ করার জন্য অসংখ্য পরাক্রমী স্বর্গদূতের—সঙ্গে আসবেন। হনোক নির্ভীকভাবে ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত সেই সাবধানবাণী লোকেদের জানিয়েছিলেন এবং তিনি একা তা প্রচার করেছিলেন! হতে পারে, তার ঠাকুরদাদার সাহসী কাজগুলো দেখে অল্পবয়সি লেমকের মধ্যে সশ্রদ্ধ ভয় জেগে উঠেছিল। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তা হলে আমরা বুঝতে পারি, কেন তার এইরকম অনুভূতি হয়েছিল।
হনোকের বিশ্বাস হয়তো আমাদের নিজেদের এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পরিচালিত করে, আমরা যে-জগতে বাস করি, সেটাকে আমরা যিহোবার মতো করে দেখি কি না। হনোক সাহসের সঙ্গে যে-বিচারের বার্তা ঘোষণা করেছিলেন, তা আজও গুরুত্বপূর্ণ; এটা বর্তমান জগতের প্রতিও প্রযোজ্য, ঠিক যেমনটা হনোকের দিনের জগতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। হনোকের সাবধানবাণী অনুযায়ী যিহোবা নোহের দিনের অধার্মিক জগতের উপর মহাজলপ্লাবন এনেছিলেন। কিন্তু, সেই ধ্বংস আসন্ন আরও বড়ো এক ধ্বংসের নমুনা স্থাপন করে। (মথি ২৪:৩৮, ৩৯; ২ পিতর ২:৪-৬) সেই সময়ের মতো বর্তমানেও ঈশ্বর এক অধার্মিক জগতের উপর ধার্মিক বিচার নিয়ে আসার জন্য তাঁর পবিত্র লোকেদের নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছেন। আমাদের প্রত্যেকেরই হনোকের সেই সাবধানবাণীর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে ও সেইসঙ্গে সেটা অন্যদের জানাতে হবে। আমাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব হয়তো আমাদের মতো একই অবস্থান গ্রহণ করবে না। তাই, কখনো কখনো আমরা হয়তো নিজেকে একা বলে মনে করতে পারি। কিন্তু, যিহোবা কখনো হনোককে পরিত্যাগ করেননি; আর তিনি বর্তমানেও তাঁর বিশ্বস্ত দাসদের পরিত্যাগ করবেন না!
“লোকান্তরে নীত হইলেন, যেন মৃত্যু না দেখিতে পান”
কীভাবে হনোকের জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল? এক অর্থে, তার মৃত্যু তার জীবনের চেয়ে আরও রহস্যময় ও আগ্রহজনক ছিল। আদিপুস্তক বইয়ের বিবরণে শুধু বলা আছে: “হনোক ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন করিতেন। পরে তিনি আর রহিলেন না, কেননা ঈশ্বর তাঁহাকে গ্রহণ করিলেন।” (আদিপুস্তক ৫:২৪) কোন অর্থে ঈশ্বর হনোককে গ্রহণ করেছিলেন? পরবর্তী সময়ে প্রেরিত পৌল ব্যাখ্যা করেছিলেন: “বিশ্বাসে হনোক লোকান্তরে নীত হইলেন, যেন মৃত্যু না দেখিতে পান; তাঁহার উদ্দেশ আর পাওয়া গেল না, কেননা ঈশ্বর তাঁহাকে লোকান্তরে লইয়া গেলেন। বস্তুতঃ লোকান্তরে নীত হইবার পূর্ব্বে তাঁহার পক্ষে এই সাক্ষ্য দেওয়া হইয়াছিল যে, তিনি ঈশ্বরের প্রীতির পাত্র ছিলেন।” (ইব্রীয় ১১:৫) “লোকান্তরে নীত হইলেন, যেন মৃত্যু না দেখিতে পান,” এই বাক্যাংশের দ্বারা পৌল কী বোঝাতে চেয়েছিলেন? কিছু বাইবেল অনুবাদে বলা আছে, ঈশ্বর হনোককে স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু, এমনটা হতে পারে না। বাইবেল দেখায় যে, যিশু খ্রিস্ট হলেন প্রথম ব্যক্তি, যাকে স্বর্গে পুনরুত্থিত করা হয়েছিল।—যোহন ৩:১৩.
তা হলে, কোন অর্থে হনোক ‘লোকান্তরে নীত হইয়াছিলেন,’ যেন তিনি ‘মৃত্যু দেখিতে’ না পান? হতে পারে, যিহোবা হনোককে মৃত্যু ইব্রীয় ১১:১৩) এরপর, হনোকের শত্রুরা হয়তো তার দেহ খোঁজার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সেটার “উদ্দেশ আর পাওয়া গেল না।” এর কারণ হতে পারে, সম্ভবত যিহোবা তার দেহ সরিয়ে ফেলেছিলেন, যাতে তারা সেটার অপব্যবহার না করে অথবা সেটা মিথ্যা উপাসনার জন্য ব্যবহার না করে। b
যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য মৃত্যুতে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু, প্রথমে হনোকের ‘পক্ষে এই সাক্ষ্য দেওয়া হইয়াছিল যে, তিনি ঈশ্বরের প্রীতির পাত্র ছিলেন।’ কীভাবে? মৃত্যুর ঠিক আগে হনোক হয়তো ঈশ্বরের কাছ থেকে একটা দর্শন পেয়েছিলেন, যেখানে তিনি হয়তো পৃথিবীকে পরমদেশের আকারে দেখতে পেয়েছিলেন। যিহোবার অনুমোদনের এই স্পষ্ট চিহ্ন দেখতে দেখতে হনোক একসময় মৃত্যুতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। হনোক ও অন্যান্য বিশ্বস্ত নারী-পুরুষ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে প্রেরিত পৌল বলেছিলেন: “বিশ্বাসানুরূপে ইহাঁরা সকলে মরিলেন।” (তাই, এই শাস্ত্রীয় যুক্তির কথা মাথায় রেখে আসুন আমরা কল্পনা করার চেষ্টা করি, হনোকের জীবন কীভাবে শেষ হয়েছিল। দৃশ্যটা মনের চোখে দেখুন, তবে মনে রাখবেন এটা কেবল এক সম্ভাবনা। হনোক ছুটে পালাচ্ছেন, তার শরীরে আর শক্তি নেই। তাড়নাকারীরা তার পিছু ধাওয়া করছে, তার বিচারের বার্তা শুনে তারা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আছে। হনোক লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে পান এবং সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন কিন্তু তিনি জানেন, তিনি এভাবে বেশি সময় পালিয়ে বেড়াতে পারবেন না। তার সামনে এক ভয়ানক মৃত্যু এগিয়ে আসছে। বিশ্রাম নেওয়ার সময় তিনি তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন। এরপর, তিনি এক গভীর শান্তি অনুভব করেন। একটা দর্শন, যা হনোকের কাছে এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, মনে হয়েছিল তিনি সশরীরে সেখানে উপস্থিত আছেন, তাকে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
কল্পনা করুন, তার সামনে এক দৃশ্য প্রকাশিত হয়, যেখানে এমন এক জগৎ দেখা যায়, যা তার সময়কার জগৎ থেকে একেবারে আলাদা। সেই জগৎকে তার এদন বাগানের মতোই অপূর্ব বলে মনে হয় কিন্তু মানুষকে দূরে রাখার জন্য সেখানে করূবরা পাহারা দিচ্ছেন না। সেখানে অসংখ্য নারী ও পুরুষ রয়েছে, যারা পুরোপুরি সুস্থসবল ও যাদের মধ্যে তারুণ্যের শক্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে শান্তি বিরাজ করছে। সেখানে ঘৃণা এবং ধর্মীয় তাড়নার লেশমাত্র নেই, যে-বিষয়গুলো হনোক নিজে ভোগ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে হনোক যিহোবার আশ্বাস, প্রেম ও অনুমোদন উপলব্ধি করতে পারেন। তিনি নিশ্চিত যে, এটাই তার জায়গা; এটাই হবে তার বাড়ি। ধীরে ধীরে আরও শান্তি অনুভব করে হনোক এক পর্যায়ে তার চোখ বন্ধ করেন এবং গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।
আর এখনও তিনি সেখানেই রয়েছেন—মৃত্যুতে ঘুমিয়ে আছেন, যিহোবা ঈশ্বরের সীমাহীন স্মৃতিতে সযত্নে রক্ষিত আছেন! পরবর্তী সময় যিশু যেমন প্রতিজ্ঞা করেছেন, এমন এক সময় আসবে, যখন ঈশ্বরের স্মৃতিতে রয়েছে এমন সকলে খ্রিস্টের রব শুনবে এবং কবর থেকে বের হয়ে আসবে আর চোখ খুলে তারা এক অপূর্ব ও শান্তিপূর্ণ নতুন জগৎ দেখতে পাবে।—যোহন ৫:২৮, ২৯.
আপনি কি সেখানে থাকতে চান? হনোকের সঙ্গে দেখা করতে পারার রোমাঞ্চকর অনুভূতি কল্পনা করে দেখুন। তার কাছ থেকে যে-চমৎকার বিষয়গুলো আমরা জানতে পারব, সেগুলো নিয়ে চিন্তা করুন! তিনি আমাদের বলতে পারবেন যে, তার জীবনের শেষ মুহূর্ত সম্বন্ধে আমাদের কাল্পনিক দৃশ্য প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে মেলে কি না। কিন্তু এখনই আমাদের তার কাছ থেকে একটা বিষয় জরুরি ভিত্তিতে শেখা প্রয়োজন। হনোক সম্বন্ধে আলোচনা করার পর পৌল আরও বলেছিলেন, “বিনা বিশ্বাসে” ঈশ্বরের “প্রীতির পাত্র হওয়া কাহারও সাধ্য নয়।” (ইব্রীয় ১১:৬) হনোক সাহসের সঙ্গে যে-বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন, তা অনুকরণ করার কত জোরালো কারণই-না আমাদের রয়েছে! ▪
a কিছু বাইবেল পণ্ডিত দাবি করে, যিহূদা এই কথাগুলো হনোকের বই নামে এক অপ্রামাণিক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি করেছেন। কিন্তু, সেই বই আসলে অনিশ্চিত উৎস থেকে আসা এক কাল্পনিক গ্রন্থ, যেটাকে মিথ্যাভাবে হনোকের দ্বারা লিখিত বই হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এটা ঠিক, সেখানে হনোকের ভাববাণী একেবারে সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তবে সেই ভাববাণী হয়তো এমন এক প্রাচীন উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে, যেটা এখন আমাদের কাছে নেই আর সেই উৎস হতে পারে লিখিত কোনো নথি অথবা পরম্পরাগত কোনো মৌখিক বিষয়। যিহূদা হয়তো সেই প্রাচীন উৎস থেকে কথাগুলো উদ্ধৃতি করেছিলেন অথবা যিশুর কাছ থেকে হনোকের বিষয়ে শুনেছিলেন কারণ যিশু স্বর্গ থেকে হনোকের জীবনধারা স্বচক্ষে দেখেছিলেন।
b একইভাবে, মোশি ও যিশুর দেহের ব্যাপারেও ঈশ্বর লক্ষ রেখেছিলেন, যাতে কোনোভাবেই তাদের দেহের অপব্যবহার না হয়।—দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:৫, ৬; লূক ২৪:৩-৬; যিহূদা ৯.