রদবদল করা পরিতৃপ্তিদায়ক হয়েছে
রদবদল করা পরিতৃপ্তিদায়ক হয়েছে
বলেছেন জেমস এ. থম্পসন
১৯২৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে যখন আমার জন্ম হয়, তখন শেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ লোকেদের মধ্যে বৈষম্যের বিষয়ে আইন ছিল। এই আইন অমান্য করা হলে জেলে যেতে হতো বা এর চেয়েও আরও খারাপ কিছু ভোগ করতে হতো।
সেই সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে শেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ যিহোবার সাক্ষিদের আলাদা আলাদা মণ্ডলী, সীমা এবং জেলা থাকতে হতো। ১৯৩৭ সালে আমার বাবা টেনেসির চেটানুগাতে অবস্থিত কৃষ্ণাঙ্গ লোকেদের নিয়ে গঠিত মণ্ডলীর কোম্পানি দাস (এখন যেটাকে প্রাচীনগোষ্ঠীর কোঅর্ডিনেটর বলা হয়) হয়েছিলেন। হ্যানরী নিকোলাস শেতাঙ্গ লোকেদের নিয়ে গঠিত মণ্ডলীর কোম্পানি দাস ছিলেন।
আমার ছোটোবেলার অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি রয়েছে আর এর মধ্যে একটা হল, রাতের বেলা পিছনের বারান্দায় বসে বাবা ও ভাই নিকোলাসের কথাবার্তা শোনা। যদিও আমি তাদের সমস্ত কথাবার্তা বুঝতে পারতাম না, তবুও বাবার পাশে বসতে আমার ভালো লাগত, যখন তারা বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যেও কীভাবে আরও সর্বোত্তম উপায়ে প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে পারে, সেই বিষয় নিয়ে আলোচনা করত।
১৯৩০ সালের শুরুর দিকে আমাদের পরিবারে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। আমার মা মাত্র ২০ বছর বয়সে মারা যান। সেই সময় আমার দিদি ডরিসের বয়স ছিল চার বছর এবং আমার বয়স ছিল দুই বছর আর তাই আমাদের দেখাশোনার ভার গিয়ে পড়ে বাবার ওপর। যদিও বাবা বেশি দিন আগে বাপ্তিস্ম নেননি, কিন্তু তিনি আধ্যাত্মিকভাবে অনেক উন্নতি করেছিলেন।
যে-উদাহরণগুলো আমার জীবনকে প্রভাবিত করেছে
১৯৩৩ সালে, বাবার সঙ্গে লিলি ম্যা গোয়েনডলিন থমাস নামে এক চমৎকার খ্রিস্টান বোনের দেখা হয় আর শীঘ্র তারা বিয়ে করে। বাবা এবং মা দুজনেই যিহোবাকে অনুগতভাবে সেবা করার বিষয়ে ডরিস দিদি এবং আমার জন্য এক উত্তম উদাহরণ স্থাপন করে।
১৯৩৮ সালে যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীগুলোকে বলা হয়েছিল, যেন তারা এই গৃহীত সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে যে, স্থানীয় মণ্ডলীর প্রাচীনদেরকে স্থানীয়ভাবে নির্বাচন করার পরিবর্তে বরং নিউ ইয়র্কে অবস্থিত ব্রুকলিনের প্রধান কার্যালয় থেকে নিযুক্ত করা হবে। চেটানুগার কেউ কেউ যখন এই পরিবর্তন মেনে নিতে ইতস্ততঃ বোধ করেছিল, তখন বাবা সাংগঠনিক রদবদলকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন করার বিষয়ে তার মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তার আনুগত্যের উদাহরণ—ও সেইসঙ্গে মায়ের আন্তরিক সহযোগিতা—এখনও পর্যন্ত আমাকে সাহায্য করছে।
বাপ্তিস্ম এবং পূর্ণসময়ের পরিচর্যা
১৯৪০ সালে, আমাদের মণ্ডলীর বেশ কয়েক জন একটা বাস ভাড়া করে মিশিগানের ডিট্রইটে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। আমাদের বাসের সেই দলের মধ্যে অল্প কয়েক জন সেখানে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। কেউ কেউ অবাক হয়েছিল যে, কেন আমি বাপ্তিস্ম নিইনি, যেহেতু আমি পাঁচ বছর বয়স থেকে প্রচার করে আসছি এবং পরিচর্যায় খুবই সক্রিয় ছিলাম।
তারা যখন আমাকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তখন আমি উত্তর দিয়েছিলাম যে, “বাপ্তিস্মের সঙ্গে জড়িত সমস্ত বিষয় আমি বুঝতে পারি না।” বাবা তা শুনতে পেয়েছিলেন এবং অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় থেকে, তিনি আমাকে বাপ্তিস্মের অর্থ এবং এর গুরুত্ব বোঝার ক্ষেত্রে সাহায্য করার জন্য আরও বেশি প্রচেষ্টা করেছিলেন। এর চার মাস পর, ১৯৪০ সালের অক্টোবর মাসের ১ তারিখে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার এক দিনে, আমি চেটানুগার বাইরে অবস্থিত একটা পুকুরে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।
১৪ বছর বয়সে, স্কুলের গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময় আমি অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। আমি টেনেসির ছোটো ছোটো শহরে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র জর্জিয়াতে প্রচার কাজ করতাম। আমি খুব ভোরে উঠে দুপুরের খাবার প্যাকেট করতাম এবং প্রচারের এলাকায় যাওয়ার জন্য সকাল ৬-টার ট্রেন অথবা বাস ধরতাম। আমি প্রায় সন্ধ্যা ৬-টার মধ্যে ফিরে আসতাম। আমি যে-খাবার প্যাকেট করে নিয়ে যেতাম, তা প্রায়ই দুপুর হওয়ার অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত। যদিও আমার কাছে টাকা থাকত কিন্তু তারপরও আমি কৃষ্ণাঙ্গ ছিলাম বলে আরও খাবার কেনার জন্য কোনো স্থানীয় দোকানে যেতে পারতাম না। একবার, আমি একটা দোকানে কোন আইসক্রিম কেনার জন্য ঢুকেছিলাম কিন্তু আমাকে বের হয়ে যেতে বলা হয়েছিল। একজন শেতাঙ্গ মহিলা সদয়ভাবে আমাকে একটা আইসক্রিম এনে দিয়েছিলেন।
আমি যখন হাই স্কুল শুরু করি, তখন দক্ষিণাঞ্চলে নাগরিক অধিকার আন্দোলন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এনএএসিপি (ন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর দ্যা এডভ্যান্সম্যান্ট অভ্ কালারড পিপল) ছাত্রদের সক্রিয় হতে উৎসাহিত করেছিল। আমাদেরকে এর সদস্য হওয়ার জন্য জোর করা হয়েছিল। কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে গঠিত বেশ কয়েকটা স্কুল, যেগুলোর মধ্যে আমার স্কুলও ছিল, ১০০ ভাগ সদস্য হওয়ার একটা লক্ষ্য স্থাপন করেছিল। আমাকে সেই সময়ে কথিত “আমাদের বর্ণকে সমর্থন করার” জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, আমি তা করা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, এই ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম যে, ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করেন না এবং একটা বর্ণের চেয়ে অন্য বর্ণের লোকেদের প্রতি অনুগ্রহ দেখান না। তাই, এই ধরনের অবিচার সমাধান করার জন্য আমি যিহোবার ওপর নির্ভর করেছিলাম।—যোহন ১৭:১৪; প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫.
হাই স্কুল শেষ করার অল্পসময় পরই, আমি নিউ ইয়র্ক সিটিতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যাওয়ার সময় আমি পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়াতে আমার কিছু বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার জন্য যাত্রাবিরতি করি, যাদের সঙ্গে আমার পূর্বে একটা সম্মেলনে দেখা হয়েছিল। সেখানে আমি যে-মণ্ডলীতে যোগ দিয়েছিলাম, সেটা আমার জন্য বর্ণগতভাবে মিশ্রিত প্রথম মণ্ডলী ছিল। ভ্রমণ অধ্যক্ষের পরিদর্শনের সময়, তিনি আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন যে, পরবর্তী সভাতে আমাকে একটা কার্যভার দেওয়া হয়েছে। সেটাই আমাকে সেখানে থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াকে সহজ করে দিয়েছিল।
ফিলাডেলফিয়াতে যাদের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলাম, তাদের মধ্যে জেরালডিন হোয়াইট নামে একজন যুবতী বোন ছিল—যাকে পরে আমি জেরি নামে ডাকতে শুরু করি। তার বাইবেল সম্বন্ধে ভালো জ্ঞান ছিল এবং সে ঘরে ঘরে পরিচর্যার
সময় গৃহকর্তার সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে দক্ষ ছিল। যে-বিষয়টা আমার কাছে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা হল একজন অগ্রগামী হওয়ার ব্যাপারে আমার মতো তারও একই লক্ষ্য ছিল। আমরা ১৯৪৯ সালের ২৩ এপ্রিল বিয়ে করি।গিলিয়েডে আমন্ত্রণ
শুরু থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিল গিলিয়েড স্কুল-এ যোগ দেওয়া এবং কোনো একটা দেশে গিয়ে মিশনারি হিসেবে সেবা করা। গিলিয়েডের জন্য যোগ্য হওয়ার ব্যাপারে আমরা আমাদের বিভিন্ন পরিস্থিতিকে রদবদল করে আনন্দিত ছিলাম। শীঘ্র, আমাদেরকে এই জায়গাগুলোতে যেতে বলা হয়েছিল যেমন, নিউ জার্সির লনসাইডে; এরপর পেনসিলভানিয়ার চেষ্টারে; আর অবশেষে নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটিতে। আটলান্টিক সিটিতে থাকাকালীন, আমরা গিলিয়ডের জন্য আবেদন করার ব্যাপারে যোগ্য হয়ে উঠি, কারণ আমাদের বিয়ে করার পর দু-বছর কেটে গিয়েছিল। কিন্তু, আমাদের আমন্ত্রণ স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। এর কারণ কী ছিল?
১৯৫০ সালের শুরুর দিকে, অনেক যুবককে সেনাবাহিনীতে সেবা করার এবং কোরিয়াতে সংগঠিত যুদ্ধে লড়াই করার জন্য জোর করে নিযুক্ত করা হচ্ছিল। ফিলাডেলফিয়ায় যারা সেই নিযুক্ত করার দায়িত্বে ছিল, তারা মনে হয় যিহোবার সাক্ষিদের পছন্দ করত না কারণ সাক্ষিরা নিরপেক্ষ ছিল। অবশেষে, আমাকে একজন বিচারক জানিয়েছিলেন যে, এফবিআই-এর মাধ্যমে আমার পটভূমি পরীক্ষা করে আমার নিরপেক্ষতার বিষয়টাকে সত্য বলে প্রমাণ করা হয়েছে। তাই, ১৯৫২ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখে প্রেসিডেন্সিয়াল অ্যাপিল বোর্ড আমাকে ফোর ডি শ্রেণীর একজন পরিচারক হিসেবে অনুমোদন প্রদান করেছিল।
সেই বছরের আগস্ট মাসে, জেরি এবং আমি গিলিয়েড স্কুলের ২০তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ লাভ করি, যেটা সেপ্টেম্বর মাসে শুরু হয়েছিল। স্কুল চলাকালীন আমরা অন্য একটা দেশে কার্যভার লাভ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিলাম। আমার দিদি ডরিস গিলিয়েডের ১৩তম ক্লাসে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন এবং ব্রাজিলে সেবা করছিলেন। জেরি এবং আমি সীমার—আলাবামা রাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে গঠিত মণ্ডলীগুলোতে পরিদর্শন করার—কার্যভার লাভ করায় কত অবাকই না হয়েছিলাম! এটা আমাদেরকে কিছুটা হতাশ করেছিল, কারণ আমরা মনেপ্রাণে অন্য একটা দেশে গিয়ে সেবা করতে চেয়েছিলাম।
আমরা প্রথম যে-মণ্ডলী পরিদর্শন করেছিলাম, সেটা হল হান্টস্ভিল। সেখানে পৌঁছানোর পর, আমরা সেই খ্রিস্টান বোনের বাড়িতে গিয়ে উঠি, যার সঙ্গে আমাদের থাকার কথা। আমরা যখন আমাদের জিনিসপত্র বের করছিলাম, তখন আমরা তাকে টেলিফোনে এই কথা বলতে শুনেছিলাম, “বাচ্চারা এখানেই আছে।” আমাদের বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর আর এমনকী আমাদেরকে দেখতেও কমবয়সি বলে মনে হতো। সেই সীমাতে সেবা করার সময়ে আমাদের নামই হয়ে ওঠে বাচ্চারা।
দক্ষিণাঞ্চলকে প্রায়ই বাইবেল বেল্ট হিসেবে উল্লেখ করা হতো, কারণ সেখানকার অধিকাংশ লোকেরই বাইবেলের প্রতি উচ্চসম্মান ছিল। তাই, আমরা প্রায়ই তিনটে বিষয় সম্বলিত এই উপস্থাপনার মাধ্যমে কথাবার্তা শুরু করতাম:
(১) জগৎ পরিস্থিতির বিষয়ে সংক্ষিপ্ত মন্তব্য।
(২) বাইবেলে উপস্থাপিত সমাধানগুলো।
(৩) আমাদের অবশ্যই যা করতে হবে, সেই সম্বন্ধে বাইবেল যা বলে।
এরপর, আমরা একটা উপযুক্ত বাইবেল অধ্যয়ন সহায়ক দিতাম। এই পদ্ধতিতে কথা বলার ক্ষেত্রে সফল হওয়ার কারণে আমাকে ১৯৫৩ সালে নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত নতুন জগৎ সমাজ
সম্মেলনে একটা কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। সেখানে আমি তিনটে বিষয় সম্বলিত এই উপস্থাপনাটা তুলে ধরেছিলাম।শীঘ্র, ১৯৫৩ সালের গ্রীষ্মকালে আমাকে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গ লোকেদের নিয়ে গঠিত সীমাতে, জেলা অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। আমাদের এলাকা ভার্জিনিয়া থেকে ফ্লোরিডা এবং আরও পশ্চিমে আলাবামা এবং টেনেসির পুরো এলাকা জুড়ে ছিল। হ্যাঁ, ভ্রমণ অধ্যক্ষদের মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের প্রায়ই এমন বাড়িতে থাকতে হতো, যেখানে ভিতরে জল সরবরাহের কোনো সুব্যবস্থা ছিল না এবং রান্নাঘরের চুলার পিছনে টিনের টাবে স্নান করতে হতো। আনন্দের বিষয় হল যে, সেটা ছিল ঘরের সবচেয়ে উষ্ণ স্থান!
বর্ণবৈষম্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতা
দক্ষিণাঞ্চলে সেবা করার সময় বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করার জন্য পূর্বপরিকল্পনা এবং উদ্ভাবনক্ষমতার প্রয়োজন ছিল। কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ধোপাখানা ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হতো না। তাই, সেখানে গিয়ে জেরিকে বলতে হতো যে, কাপড়গুলো “মিসেস থম্পসনের।” অনেকে মনে করত যে, সে একজন পরিচারিকা আর “মিসেস থম্পসন” হচ্ছেন গৃহকর্ত্রী। জেলা অধ্যক্ষদেরকে যখন নতুন জগৎ সমাজ কার্যরত (ইংরেজি), নামক চলচ্চিত্র দেখানো হতো, তখন আমাকে দোকানে টেলিফোন করতে এবং “মিঃ থম্পসনের” জন্য একটা বড়ো পর্দা ভাড়া করতে হতো। পরে, আমি দোকানে গিয়ে তা নিয়ে আসতাম। আমরা সবসময় বিনয়ী ছিলাম এবং সাধারণত কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমাদের পরিচর্যা সম্পন্ন করতাম।
আরেক ধরনের ভেদাভেদও ছিল আর সেটা হল, উত্তরাঞ্চল থেকে আসা ব্যক্তিদের প্রতি আঞ্চলিক ভেদাভেদ। একটা স্থানীয় সংবাদপত্র একবার রিপোর্ট করেছিল যে, ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল অ্যান্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটি অভ্ নিউ ইয়র্কের জেমস এ. থম্পসন, জুনিয়র একটা সম্মেলনে বক্তৃতা দেবেন। কেউ কেউ এটা পড়ে মনে করেছিল যে, আমি নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছি আর সেই কারণে স্কুল মিলনায়তন ব্যবহার করার জন্য যে-চুক্তি করা হয়েছিল, তা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। তাই, আমি স্কুল বোর্ডের কাছে গিয়েছিলাম এবং ব্যাখ্যা করেছিলাম যে, আমি চেটানুগার স্কুলে পড়াশোনা করেছি। আর এর ফলে, আমরা আমাদের সীমা সম্মেলন করার জন্য অনুমতি পেয়েছিলাম।
১৯৫০ দশকের মধ্যবর্তী সময়ে বর্ণগত উত্তেজনা বেড়ে চলছিল আর মাঝে মাঝে বিভিন্ন দৌরাত্ম্যমূলক ঘটনা ঘটছিল। ১৯৫৪ সালের কয়েকটা সম্মেলনে, কার্যক্রমে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ বক্তা ছিল না বলে কিছু সাক্ষি অসন্তুষ্ট হয়েছিল। আমরা আমাদের কৃষ্ণাঙ্গ ভাইদেরকে ধৈর্য ধরতে উৎসাহিত করেছিলাম। পরের গ্রীষ্মের সম্মেলনে আমাকে বক্তা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে, দক্ষিণাঞ্চলের আরও কৃষ্ণাঙ্গ ভাইয়েরা কার্যক্রমে সুযোগ পেয়েছিল।
এক সময়, দক্ষিণাঞ্চলের বর্ণগত দৌরাত্ম্য শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং মণ্ডলীগুলো ধীরে ধীরে সম্মিলিত হতে শুরু করেছিল। এর জন্য প্রকাশকদেরকে পুনরায় ভিন্ন ভিন্ন মণ্ডলীতে নিয়োগ করার ও সেইসঙ্গে মণ্ডলীর এলাকাগুলোতে এবং তত্ত্বাবধান করছিল এমন ভাইদের দায়িত্বগুলোকে রদবদল করার প্রয়োজন হয়েছিল। কৃষ্ণাঙ্গ এবং শেতাঙ্গদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ এই নতুন ব্যবস্থায় খুশি ছিল না। তবে, বেশিরভাগ প্রকাশকই আমাদের স্বর্গীয় পিতার ন্যায় পক্ষপাতহীন মনোভাব দেখিয়েছিল। বাস্তবিকপক্ষে, অনেকেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিল, তা তাদের বর্ণ যা-ই হোক না কেন। ১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকে অর্থাৎ আমার বেড়ে ওঠার সময়ে আমাদের পরিবারও এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল।
এক নতুন কার্যভার
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে, জেরি এবং আমি দক্ষিণ আমেরিকার গায়েনাতে যাওয়ার আমন্ত্রণ পাই আর আমরা সেই আমন্ত্রণ আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করি। প্রথমে আমরা নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে যাই, যেখানে আমি গায়েনাতে প্রচার কাজের দেখাশোনা করার জন্য প্রশিক্ষণ লাভ করি। আমরা সেখানে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে গিয়ে পৌঁছাই। ১৬ বছর ধরে ভ্রমণের কাজ করার পর, একটা স্থানে অবস্থান করা এক বিরাট রদবদল ছিল। জেরি একজন মিশনারি হিসেবে দিনের বেশিরভাগ সময়ই ক্ষেত্রের পরিচর্যায় ব্যয় করত আর আমি শাখা অফিসে কাজ করতাম।
আমাকে ঘাস কাটা এবং ২৮-টা মণ্ডলীর সাহিত্যাদি দেখাশোনা থেকে শুরু করে ব্রুকলিনের প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার মতো যাবতীয় সব ধরনের কাজ করতে হতো। আমাকে প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ ঘন্টা কাজ করতে হতো। আমাদের দুজনের জন্যই এটা অনেক কঠিন ছিল কিন্তু আমরা আমাদের কার্যভার উপভোগ করতাম। যখন আমরা গায়েনাতে এসেছিলাম, তখন সেখানে মাত্র ৯৫০ জন প্রকাশক ছিল; আর এখন সেখানে ২,৫০০ জনেরও বেশি প্রকাশক রয়েছে।
যদিও আমরা সেখানকার চমৎকার তাপমাত্রা এবং বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ও শাকসবজি উপভোগ করতাম, তবে আমাদের প্রকৃত আনন্দ এটা ছিল যে, সেখানকার নম্র লোকেরা, যারা বাইবেলের সত্যের প্রতি আকুল আকাঙ্ক্ষী ছিল, ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে শিখছিল। প্রতি সপ্তাহে প্রায়ই জেরিকে ২০টা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতে হতো আর আমরা যাদেরকে অধ্যয়ন করাতাম, তাদের মধ্যে অনেকেই বাপ্তিস্ম নেওয়ার মতো উন্নতি করেছিল। পরবর্তী সময়ে, কেউ কেউ অগ্রগামী ও মণ্ডলীর প্রাচীন হয়ে উঠেছিল আর এমনকী মিশনারি হওয়ার জন্য গিলিয়েডে গিয়েছিল।
বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিশেষভাবে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত
১৯৮৩ সালে, যুক্তরাষ্ট্রে আমার বাবা-মায়ের সাহায্যের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। ডরিস দিদি, জেরি এবং আমি একটা পারিবারিক বৈঠক করেছিলাম। ডরিস দিদি, যিনি ৩৫ বছর ধরে ব্রাজিলে একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করেছিলেন, তিনি সেখান থেকে ফিরে এসে তাদের দেখাশোনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যেখানে একজনই এই কাজের দেখাশোনা করতে পারে, সেখানে ক্ষেত্র থেকে দুজন মিশনারির আসার কী প্রয়োজন? আমাদের বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর, ডরিস দিদি চেটানুগাতেই থেকে যান এবং একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করেন।
১৯৯৫ সালে আমার প্রোস্টেট ক্যানসার ধরা পরে আর এই কারণে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসতে হয়। আমরা নর্থ ক্যারোলিনার গোল্ডস্বোরোতে থাকতে শুরু করি কারণ সেই জায়গাটা টেনেসিতে বসবাসরত আমার পরিবার এবং পেনসিলভানিয়াতে বসবাসরত জেরির পরিবারের প্রায় মাঝামাঝিতে ছিল। আমার ক্যানসার এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আর আমরা গোল্ডস্বোরোর একটা মণ্ডলীতে শারীরিকভাবে দুর্বল এমন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি।
আমি যখন ৬৫ বছরের পূর্ণসময়ের পরিচর্যার দিকে ফিরে তাকাই, তখন আমি সত্যিই এই বিষয়ে কৃতজ্ঞ হই যে, যিহোবা জেরি এবং আমাকে তাঁকে সেবা করার জন্য বিভিন্ন রদবদল করার ব্যাপারে আশীর্বাদ করেছেন। দায়ূদের এই কথাগুলো কতই না সত্য: ‘সদাপ্রভু বিশ্বস্তদের সঙ্গে বিশ্বস্ত ব্যবহার করবেন’!—২ শমূ. ২২:২৬, বাংলা কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ভারসন।
[৩ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
আমার বাবা ও সেইসঙ্গে ভাই নিকোলাস আমার জন্য এক চমৎকার উদাহরণ স্থাপন করেন
[৪ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
১৯৫২ সালে জেরির সঙ্গে, গিলিয়েডে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত
[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
গিলিয়েডে যোগদান করার পর, আমাদেরকে দক্ষিণাঞ্চলে ভ্রমণ কাজে নিযুক্ত করা হয়
[৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৬৬ সালে ভ্রমণ অধ্যক্ষ এবং তাদের স্ত্রীরা সম্মিলিত এক জেলা সম্মেলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
গায়েনাতে মিশনারি সেবা আনন্দদায়ক ছিল