‘আমার মনোবাঞ্ছা সকল’ পূর্ণ হয়েছিল
জীবন কাহিনী
‘আমার মনোবাঞ্ছা সকল’ পূর্ণ হয়েছিল
বলেছেন ডমিনিক মরগিউ
শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি আফ্রিকায় এসে পৌঁছেছিলাম! আমার ছেলেবেলার স্বপ্ন তখন বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। আমি সবসময়ই আফ্রিকার বিস্তীর্ণ, উন্মুক্ত এলাকা এবং আকর্ষণীয় বন্যজীবনের বিষয়ে চিন্তা করে রোমাঞ্চিত হতাম। তখন আমি সত্যি সত্যিই সেখানে ছিলাম! একই সময়ে আমার আরেকটা স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। আমি একজন পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক হিসেবে বিদেশে সেবা করছিলাম। অনেকের কাছে এটা হয়তো অসম্ভব বলে মনে হতে পারে। আমার দৃষ্টিশক্তি খুবই দুর্বল ছিল আর আমি অন্ধদের পথ দেখাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটা কুকুরের সাহায্য নিয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন গ্রামে বালিপূর্ণ রাস্তায় হাঁটতাম, যেটাকে আসলে ইউরোপের শহরের রাস্তার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এর আগে আমি বলছি যে, কীভাবে আমার পক্ষে আফ্রিকায় সেবা করা সম্ভব হয়েছিল এবং কীভাবে যিহোবা ‘আমার মনোবাঞ্ছা সকল’ পূর্ণ করেছিলেন।—গীতসংহিতা ৩৭:৪.
উনিশশো ছেষট্টি সালের ৯ই জুন ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে আমার জন্ম হয়। আমি সাত ছেলেমেয়ের—দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের—মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলাম আর আমরা সকলে প্রেমময় বাবামার যত্নে বড় হয়েছিলাম। কিন্তু, ছেলেবেলায় আমার জীবনে একটা অন্ধকারময় দিক ছিল। আমার দিদিমা, মা ও একজন দিদির মতো আমারও একটা বংশগত রোগ ছিল, যেটা শেষপর্যন্ত পুরোপুরি অন্ধ করে দেয়।
একজন কিশোরী হিসেবে আমি বর্ণবৈষম্য, পক্ষপাতিত্ব এবং কপট আচরণের মুখোমুখি হয়েছিলাম, যা আমাকে সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। এটা ছিল এক কষ্টকর সময় যখন আমরা আ্যরো অঞ্চলে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে এক চমৎকার ঘটনা ঘটেছিল।
এক রবিবার সকালে দুজন যিহোবার সাক্ষি আমাদের দরজায় এসেছিল। আমার মা তাদের চিনতেন আর তাই তাদেরকে গালাতীয় ২:১৪.
ভিতরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দুজন মহিলার মধ্যে একজন মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, মা যে একবার বাইবেল অধ্যয়ন করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা তার মনে আছে কি না। মার মনে পড়েছিল এবং তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কখন আমরা শুরু করতে পারি?” তারা প্রতি রবিবার সকালে আসতে রাজি হয়েছিল আর এভাবেই আমার মা “সুসমাচারের সত্য” শিখতে শুরু করেছিলেন।—অন্তর্দৃষ্টি লাভ করা
মা যে-বিষয়গুলো শিখেছিলেন সেগুলো বোঝার ও মনে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করতেন। অন্ধ হওয়ায় তাকে সবকিছুই মুখস্থ করতে হতো। সাক্ষিরা তার সঙ্গে খুবই ধৈর্যশীল ছিল। আর আমি, যখনই সাক্ষিরা আসত আমার ঘরে লুকিয়ে থাকতাম এবং তারা চলে যাওয়ার পর বের হতাম। কিন্তু, একদিন দুপুরবেলা ইউজিনি নামে সাক্ষিদের মধ্যে একজন আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে, ঈশ্বরের রাজ্য এই জগতের সকল কপটতা, ঘৃণা এবং পক্ষপাতিত্বকে দূর করবে। “একমাত্র ঈশ্বরের কাছেই সমাধানের চাবিকাঠি রয়েছে,” তিনি বলেছিলেন। আমি কি আরও জানতে চেয়েছিলাম? পরদিন আমি বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিলাম।
আমি যে-বিষয়গুলো শিখেছিলাম সবকিছুই আমার কাছে নতুন ছিল। এরপরই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, উপযুক্ত কারণগুলোর জন্যই ঈশ্বর পৃথিবীতে সাময়িকভাবে দুষ্টতা থাকতে দিয়েছেন। (আদিপুস্তক ৩:১৫; যোহন ৩:১৬; রোমীয় ৯:১৭) এ ছাড়া, আমি শিখেছিলাম যে যিহোবা আমাদের নিরাশার মধ্যে পরিত্যাগ করেন না। তিনি আমাদের কাছে এক পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্তজীবনের চমৎকার প্রতিজ্ঞা করেছেন। (গীতসংহিতা ৩৭:২৯; ৯৬:১১, ১২; যিশাইয় ৩৫:১, ২; ৪৫:১৮) সেই পরমদেশে আমি আবারও দৃষ্টিশক্তির দান ফিরে পাব, যা আমি ধীরে ধীরে হারাচ্ছিলাম।—যিশাইয় ৩৫:৫.
পূর্ণসময়ের কাজ গ্রহণ করা
আমি ১৯৮৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর যিহোবার কাছে উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে জলে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম এবং আমার দিদি ম্যারি ক্ল্যারের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম, যে ইতিমধ্যেই এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। শীঘ্রই আমার দাদা জ্যাঁ পিয়ের, আমার প্রিয় মায়ের মতো একই পথ অনুসরণ করেছিল।
আমি যে-মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করতাম সেখানে কয়েক জন নিয়মিত অগ্রগামী এবং পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক ছিল। আমি পরিচর্যার জন্য তাদের উদ্যম ও আনন্দ দেখে উৎসাহিত হয়েছিলাম। ম্যারি ক্ল্যার চোখের সমস্যা এবং পায়ে অর্থোপেডিক ডিভাইস (পায়ের গঠন সোজা রাখার জন্য বিশেষ যন্ত্র) থাকা সত্ত্বেও, পূর্ণসময়ের পরিচর্যা গ্রহণ করেছিল। আজ পর্যন্ত সে আমাকে ক্রমাগত উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। মণ্ডলীতে এবং পরিবারে অগ্রগামীদের সাহচর্য, আমার মধ্যে পূর্ণসময়ের পরিচর্যায় অংশ নেওয়ার আকুল আকাঙ্ক্ষা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। তাই, ১৯৯০ সালের নভেম্বর মাসে আমি বেজিয়ে শহরে একজন অগ্রগামী হিসেবে সেবা করতে শুরু করেছিলাম।—গীতসংহিতা ৯৪:১৭-১৯.
নিরুৎসাহিতাকে সফলভাবে মোকাবিলা করা
পরিচর্যায় অন্যান্য অগ্রগামীরা সবসময় আমার দিকে নজর রাখত, যা আমার জন্য সাহায্যকারী ছিল। তবুও, মাঝে মাঝে আমি আমার সীমাবদ্ধতার কারণে নিরুৎসাহিত বোধ করতাম এবং আমার মনে হতো যে যদি আমি আরেকটু বেশি করতে পারতাম। কিন্তু, যিহোবা নিরুৎসাহিতার সেই সময়গুলোতে আমাকে শক্তি দান করেছিলেন। আমার মতো দুর্বল দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন অগ্রগামীদের জীবন কাহিনী খোঁজার জন্য আমি ওয়াচটাওয়ার পাববিকেশনস্ ইনডেক্স-এ গবেষণা করেছিলাম। এত এত সংখ্যা খুঁজে পেয়ে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! এই ব্যবহারিক এবং উৎসাহজনক ঘটনাগুলো আমাকে, আমার সক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতাগুলো মেনে নিতে শিক্ষা দিয়েছিল।
নিজের ভরণপোষণের জন্য আমি অন্যান্য সাক্ষিদের সঙ্গে বিভিন্ন শপিং মল পরিষ্কার করার কাজ করেছিলাম। একদিন আমি লক্ষ করি যে, আমার সহকর্মীরা আবারও সেই জায়গা পরিষ্কার করতে যাচ্ছিল, যেখানে আমি এইমাত্র পরিষ্কার করে এসেছিলাম। নিশ্চয়ই অনেক ময়লা আমার চোখে পড়েনি। আমি ভ্যালেরির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম যিনি আমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দলের দায়িত্বে ছিলেন এবং তাকে খোলাখুলিভাবে বলতে বলেছিলাম যে, আমি অন্য সকলের জন্য কাজকে আরও কঠিন করে তুলছিলাম কি না। আমি কখন কাজটা ছেড়ে দিতে চাই, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টা তিনি সদয়ভাবে আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে আমি পরিষ্কার করার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম।
আমি আবারও অকেজো মনে করার অনুভূতির দ্বারা জর্জরিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি ঐকান্তিকভাবে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম এবং আমি জানি যে তিনি আমার অনুরোধ শুনেছিলেন। বাইবেল এবং খ্রিস্টীয় প্রকাশনাগুলো অধ্যয়ন করা আবারও অনেক সাহায্যকারী হয়েছিল। যদিও আমার দৃষ্টিশক্তি দিন দিন
দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু যিহোবার সেবা করার জন্য আমার আকাঙ্ক্ষা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আমি কী করতে পারি?প্রথমে এক অপেক্ষা-তালিকা, এরপর এক দ্রুত সিদ্ধান্ত
আমি নিমে অবস্থিত অন্ধ ও দুর্বল দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করেছিলাম এবং শেষ পর্যন্ত তিন মাসের জন্য ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে যে-সময় ব্যয় করা হয়েছিল, তা সার্থক হয়েছিল। আমি আমার অক্ষমতার ব্যাপকতা বুঝতে পেরেছিলাম এবং এটার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিখেছিলাম। সব ধরনের দুর্বলতার শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করা আমাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, আমার খ্রিস্টীয় আশা কতখানি মূল্যবান। আমার অন্তত একটা লক্ষ্য ছিল আর আমি ফলদায়ক কিছু করতে পারতাম। এ ছাড়া, আমি ফ্রেঞ্চ ব্রেইল অক্ষরও শিখেছিলাম।
আমি যখন ঘরে ফিরে এসেছিলাম তখন আমার পরিবার লক্ষ করেছিল যে, সেই প্রশিক্ষণ আমাকে কতটা সাহায্য করেছিল। তবে একটা জিনিস অর্থাৎ আমাকে যে-সাদা ছড়ি ব্যবহার করতে হতো, সেটা আমি একটুও পছন্দ করতাম না। চলাফেরা করার জন্য আমাকে “লাঠি” ব্যবহার করতে হবে, এই বিষয়টা মেনে নেওয়া আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিল। এর চেয়ে অন্য কোনো সাহায্য নিলে আরও ভাল হতো—হয়তো একটা পথপ্রদর্শক কুকুর।
আমি একটা কুকুরের জন্য আবেদন করেছিলাম কিন্তু আমাকে বলা হয়েছিল যে, এর জন্য ইতিমধ্যেই একটা দীর্ঘ অপেক্ষা-তালিকা ছিল। এ ছাড়া, সেই সংস্থাকে একটা বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। যেকোনো ব্যক্তিকেই এইরকম পথপ্রদর্শক কুকুর দেওয়া হয় না। একদিন একজন মহিলা যিনি অন্ধদের জন্য একটা সংস্থা চালাতে সাহায্য করেন, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে, স্থানীয় একটা টেনিস ক্লাব আমাদের এলাকায় বসবাসকারী একজন অন্ধ বা আংশিক দৃষ্টিশক্তিহীন ব্যক্তিকে একটা পথপ্রদর্শক কুকুর দান করতে যাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন যে, তিনি আমার কথা চিন্তা করেছিলেন। আমি কি সেটা নেব? আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে এই ব্যাপারে যিহোবার হাত ছিল এবং সেই সদয় প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম। তা সত্ত্বেও, আমাকে কুকুরটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
তখনও আফ্রিকার চিন্তা ছিল
অপেক্ষা করার সময় আমি অন্যদিকে মনোযোগ দিয়েছিলাম। আমি আগেই যেমন উল্লেখ করেছিলাম যে, ছোটবেলা থেকে
আফ্রিকার ব্যাপারে আমি খুবই আগ্রহী ছিলাম। আমার দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও সেই আগ্রহ আগের চেয়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল, বিশেষভাবে তখন থেকে যখন আমি জেনেছিলাম যে আফ্রিকার অনেক লোক বাইবেলের প্রতি এবং যিহোবার সেবার প্রতি আগ্রহী। কিছুদিন আগে আমি ভ্যালেরিকে হঠাৎ করেই বলেছিলাম যে, আমি আফ্রিকায় বেড়াতে যেতে চাই। তিনি কি আমার সঙ্গে যেতে চান? তিনি রাজি হয়েছিলেন এবং আমরা আফ্রিকায় যিহোবার সাক্ষিদের ফ্রেঞ্চভাষী শাখা অফিসের কয়েকটাতে চিঠি লিখেছিলাম।টোগো থেকে একটা উত্তর এসেছিল। রোমাঞ্চিত হয়ে আমি ভ্যালেরিকে আমার সামনে চিঠিটা পড়তে অনুরোধ করেছিলাম। চিঠিটা উৎসাহজনক ছিল তাই ভ্যালেরি বলেছিলেন: “তা হলে, আমরা কেন যাচ্ছি না?” শাখা অফিসের ভাইদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ করার পর, আমাকে রাজধানী শহর লোমের একজন অগ্রগামী স্যান্ড্রার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা ১৯৯৮ সালের ১লা ডিসেম্বর সেখানে যাব বলে স্থির করেছিলাম।
কত আলাদাই না ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা কতই না আনন্দিত ছিলাম! লোমে শহরে অবতরণের পর প্লেন থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মনে হয়েছিল যেন আফ্রিকার প্রচণ্ড গরম আমাদের কম্বলের মতো চেপে রেখেছে। স্যান্ড্রা আমাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আমরা একে অপরকে আগে কখনো দেখিনি কিন্তু আমাদের মনে হয়েছিল যেন আমরা কত পুরোনো বন্ধু। আমরা সেখানে পৌঁছানোর কিছুদিন আগে স্যান্ড্রা এবং তার সহকারী ক্রিস্টিনকে, দেশের মধ্যবর্তী অংশের একটা ছোট শহর টেবলিগবোতে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। আমরা এখন তাদের নতুন কার্যভারে তাদের সঙ্গী হওয়ার বিশেষ সুযোগ পেয়েছিলাম। আমরা সেখানে প্রায় দুই মাস ছিলাম এবং সেই জায়গা ছেড়ে আসার সময় আমি জানতাম যে, আমি আবার ফিরে আসব।
ফিরে আসতে পেরে আনন্দিত
ফ্রান্সে ফিরেই আমি টোগোতে আমার দ্বিতীয় ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম। আমার পরিবারের সমর্থন পেয়ে আমি সেখানে ছয় মাস থাকার জন্য ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাই, ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি আবারও টোগোর উদ্দেশে প্লেনে চড়েছিলাম। কিন্তু এবার আমি একা ছিলাম। আমার পরিবারের অনুভূতির কথা একটু ভেবে দেখুন, যখন তারা দেখেছিল যে আমার অক্ষমতা সত্ত্বেও আমি একা একা তাদের ছেড়ে যাচ্ছি! কিন্তু দুঃশ্চিন্তা করার কোনো কারণই ছিল না। আমি আমার বাবামাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম যে, আমার বন্ধুরা যারা ইতিমধ্যে আমার পরিবারের মতোই হয়ে গিয়েছিল, তারা লোমেতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
অনেক লোক বাইবেলের প্রতি আগ্রহ দেখায় এমন এক এলাকায় ফিরে আসা কত আনন্দদায়কই না ছিল! লোকেদের রাস্তায় বসে বাইবেল পড়তে দেখা, কোনো অসাধারণ ব্যাপার ছিল না। টেবলিগবোর লোকেরা শুধুমাত্র বাইবেল আলোচনা করার জন্য আপনাকে ডাকবে। আর দুজন অগ্রগামী বোনের সঙ্গে একটা সাধাসিধে ঘরে একসঙ্গে থাকা কী এক বিশেষ সুযোগই না ছিল! আমি আরেকটা সংস্কৃতির সঙ্গে, বিষয়গুলোকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। সবচেয়ে প্রথমে আমি লক্ষ করেছিলাম যে, আফ্রিকার খ্রিস্টান ভাইবোনেরা রাজ্যের আগ্রহকে তাদের জীবনে প্রথম স্থানে রাখে। উদাহরণস্বরূপ, কিংডম হলে আসার জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটা, তাদেরকে সভায় উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেয় না। এ ছাড়া, আমি তাদের উষ্ণতা এবং আতিথেয়তা থেকে অনেক শিক্ষা পেয়েছিলাম।
একদিন ক্ষেত্রের পরিচর্যা থেকে ফিরে আসার সময় আমি স্যান্ড্রাকে বলেছিলাম যে, আমি ফ্রান্সে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম। আমার দৃষ্টিশক্তির আরও অবনতি হয়েছিল। আমি বেজিয়ের
লোকেদের ভিড় ও কোলাহলপূর্ণ রাস্তা, বড় বড় আ্যপার্টমেন্টের সিঁড়ি এবং অন্যান্য অনেক বিষয় নিয়ে চিন্তা করেছিলাম, যেগুলো আমার মতো কম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন একজন ব্যক্তির জীবনকে কঠিন করে তোলে। এর বিপরীতে, টেবলিগবোর রাস্তাগুলো যদিও পাকা নয় কিন্তু বেশ শান্ত—অতিরিক্ত ভিড় নেই আর খুব বেশি যানবাহনও নেই। যেহেতু আমি তখন টেবলিগবোর জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম, তাই ফ্রান্সে গিয়ে আমি কীভাবে চলব?দুদিন পর আমার মা আমাকে এটা বলতে ফোন করেছিলেন যে, পথপ্রদর্শক কুকুরদের স্কুল আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওসেয়্যান নামে ল্যাব্রাডর প্রজাতির একটা বাচ্চা কুকুর আমার “চোখ” হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। আরও একবার আমার প্রয়োজন মেটানো হয়েছিল এবং আমার দুশ্চিন্তা দূর হয়েছিল। টেবলিগবোতে ছয় মাসের আনন্দময় পরিচর্যা শেষে, আমি ওসেয়্যানের সঙ্গে দেখা করতে ফ্রান্সে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম।
কয়েক মাস প্রশিক্ষণের পর, ওসেয়্যানের ওপর আমার দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। প্রথম প্রথম এটা সহজ ছিল না। আমাদের একে অপরকে বোঝার জন্য শিখতে হয়েছিল। যাই হোক, ধীরে ধীরে আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে, ওসেয়্যান আমার জন্য কতটা প্রয়োজনীয় ছিল। বাস্তবে ওসেয়্যান এখন আমার জীবনেরই একটা অংশ। বেজিয়ের লোকেরা কী প্রতিক্রিয়া দেখাত, যখন তারা আমাকে একটা কুকুরসহ তাদের দরজায় আসতে দেখত? আমাকে অনেক সম্মান এবং দয়া দেখানো হতো। ওসেয়্যান আমাদের এলাকার “নায়ক” হয়ে ওঠেছিল। যেহেতু অনেক লোক একজন অক্ষম ব্যক্তির উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করে থাকে, তাই সঙ্গে কুকুর থাকা আমাকে আমার দুর্বলতার বিষয়ে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে সক্ষম করেছিল। লোকেরা স্বস্তি বোধ করত এবং আমার কথা শুনত। বস্তুতপক্ষে, ওসেয়্যান আলোচনা শুরু করার সর্বোত্তম উপায় হয়ে ওঠেছিল।
ওসেয়্যানের সঙ্গে আফ্রিকায়
আমি আফ্রিকার বিষয় ভুলে যাইনি আর তখন আমি আমার তৃতীয় ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম। এবার ওসেয়্যান আমার সঙ্গে গিয়েছিল। এ ছাড়া, আমার সঙ্গী হয়েছিল আ্যন্টনি এবং অররো নামে এক অল্পবয়সি দম্পতি ও আমার বান্ধবী ক্যারোলিন—যারা সকলে আমার মতো অগ্রগামী ছিল। আমরা ২০০০ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর লোমেতে পৌঁছেছিলাম।
প্রথম প্রথম অনেকেই ওসেয়্যানকে ভয় পেত। লোমের খুব অল্প লোকই এত বড় একটা কুকুর দেখেছিল কারণ টোগোর বেশির ভাগ কুকুরই ছোট প্রজাতির ছিল। যখন তারা এটার সাজসরঞ্জাম দেখত, তখন কেউ কেউ মনে করত যে, এটা একটা হিংস্র প্রাণী আর এরজন্যই বুঝি এটাকে আটকে রাখতে হয়। ওসেয়্যান এক প্রতিরক্ষামূলক মনোভাব গড়ে তুলেছিল, আমার জন্য হুমকি হিসেবে মনে হতো এমন যেকোনো বিষয় থেকে আমাকে রক্ষা করতে সে প্রস্তুত ছিল। তা সত্ত্বেও, ওসেয়্যান শীঘ্রই নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল। সাজসরঞ্জাম পরা অবস্থায় সে তার কাজে রত থাকে—সুশৃঙ্খল, দায়িত্ববান এবং আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। যখন তার সাজসরঞ্জাম খুলে ফেলা হয়, তখন সে খেলা করে, মাঝে মাঝে দুষ্টুমিও করে। আমরা একসঙ্গে অনেক মজা করি।
টেবলিগবোতে আমাদের সবাইকে স্যান্ড্রা এবং ক্রিস্টিনের সঙ্গে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। স্থানীয় ভাইবোনদের ওসেয়্যানের সঙ্গে অভ্যস্ত করানোর জন্য আমরা তাদেরকে আমাদের ঘরে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং একটা পথপ্রদর্শক কুকুরের কাজ, কেন আমার তা দরকার হয়েছিল এবং তার সঙ্গে তাদের কীরকম আচরণ করা উচিত, সেই সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলাম। ওসেয়্যানের যে আমার সঙ্গে কিংডম হলে আসা উচিত সেই ব্যাপারে প্রাচীনরা একমত হয়েছিল। যেহেতু টোগোতে এই ব্যবস্থা খুবই অস্বাভাবিক ছিল, তাই মণ্ডলীতে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে একটা ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। আর পরিচর্যায় ওসেয়্যান আমার সঙ্গে কেবল পুনর্সাক্ষাৎ ও বাইবেল অধ্যয়নে যেত, যে-পরিস্থিতিগুলোতে তার উপস্থিতির কারণ লোকেরা সহজেই বুঝতে পারবে।
এই ক্ষেত্রে প্রচার করা ক্রমাগত আনন্দ নিয়ে এসেছিল। অমায়িক লোকেদের বিবেচনাবোধ সবসময় আমার হৃদয় স্পর্শ করত, যা তারা তাদের বিভিন্ন দয়ার কাজ, যেমন আগ্রহ সহকারে আমাকে একটা চেয়ার এগিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে দেখাত। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে টোগোতে চতুর্থ ভ্রমণে আমার মা আমার সঙ্গে এসেছিলেন। তিন সপ্তাহ পর তিনি আশ্বস্ত এবং আনন্দিত হয়ে ফ্রান্সে ফিরে গিয়েছিলেন।
টোগোতে সেবা করতে পারায় আমি যিহোবার কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমার এই আস্থা রয়েছে যে, যিহোবা ক্রমাগত ‘আমার মনোবাঞ্ছা সকল’ পূর্ণ করবেন কারণ আমি আমার সবকিছুই তাঁর সেবায় ব্যবহার করে যাচ্ছি। *
[পাদটীকা]
^ বোন মরগিউ ফ্রান্সে ফিরে এসেছিলেন এবং ২০০৩ সালের ৬ই অক্টোবর থেকে ২০০৪ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টোগোতে তার পঞ্চম ভ্রমণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, চিকিৎসা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সম্ভবত সেটাই এই বিধিব্যবস্থায় টোগোতে তার শেষ ভ্রমণ। তা সত্ত্বেও, যিহোবার সেবা করে চলার বিষয়ে তার দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।
[১০ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
আমি সবসময়ই আফ্রিকার বিস্তীর্ণ, উন্মুক্ত এলাকা এবং আকর্ষণীয় বন্যজীবনের বিষয়ে চিন্তা করে রোমাঞ্চিত হতাম
[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]
ওসেয়্যান আমার সঙ্গে পুনর্সাক্ষাৎগুলোতে যেত
[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]
প্রাচীনরা এই বিষয়ে একমত হয়েছিল যে, আমার ওসেয়্যানকে নিয়ে সভাগুলোতে আসা উচিত