পালক এক চমৎকার নকশা
পালক এক চমৎকার নকশা
একটা গাংচিল তার ডানাগুলোকে নীচের দিকে ঠেলে আকাশের দিকে উড়ে যায়। আকাশের দিকে ওঠার সময় এটা চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে সহজেই বাতাসে উড়ে বেড়ায়। এর ডানাগুলো এবং পুচ্ছকে শুধু সামান্য নাড়াচাড়া করেই এই পাখি বলতে গেলে প্রায় স্থিরভাবে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। কী এই পাখিকে এত সহজে ও নিখুঁতভাবে এই কাজগুলো করতে সক্ষম করে? মূলত এর পালকগুলোই তা করতে সমর্থ করে।
আজকে পাখিই হচ্ছে একমাত্র প্রাণী, যাদের পালক জন্মায়। অধিকাংশ পাখির বিভিন্ন ধরনের পালক রয়েছে। যে-পালকগুলো সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, সেগুলো হল একটার ওপর একটা ছড়িয়ে থাকা কনট্যুর পালক, যেগুলো পাখিগুলোকে মসৃণ গড়ন ও সেইসঙ্গে ওড়ার মতো আকার প্রদান করে। এই কনট্যুর পালকগুলো মূলত ডানা ও পুচ্ছের পালকগুলো নিয়ে গঠিত, যেগুলো ওড়ার জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। একটা হামিংবার্ডের কম করে হলেও এই ধরনের ১,০০০টা কনট্যুর পালক রয়েছে এবং একটা রাজহাঁসের ২৫,০০০রেরও বেশি পালক রয়েছে।
পালকগুলোতে এক চমৎকার নকশা রয়েছে। পালকের মধ্যবর্তী শ্যাফট, যেটাকে র্যাকিস বলা হয়, সেটা নমনীয় এবং বেশ শক্ত। এটার মধ্যে থেকে সারিবদ্ধভাবে একটার পর একটা ঘনভাবে বিন্যস্ত বার্ব বের হয়, যেগুলো পালকের মসৃণ ভেইন গঠন করে। বার্বগুলো শত শত ক্ষুদ্র বার্বিউলের মাধ্যমে একটা অন্যটার সঙ্গে যুক্ত থাকে, যেগুলো আশেপাশের বার্বিউলগুলোর সঙ্গে আটকে থাকে আর এটাকে দেখতে জিপারের মতো লাগে। বার্বিউলগুলো যখন আলগা হয়, তখন পাখি সেগুলোকে আবার গুটিয়ে নিয়ে পরিপাটী করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। আপনি একটা ঝরে পড়া পালককে আপনার আঙুলের মাঝে আলতোভাবে বুলিয়ে একই বিষয় করতে পারেন।
ডানার উড্ডয়ন পালকগুলো মূলত অপ্রতিসম—ভেইনের পিছনের প্রান্তের চেয়ে সামনের প্রান্ত তুলনামূলকভাবে বেশি সরু। আদর্শ এয়ারফয়েল নকশার অনুরূপ পালকের এই নকশা প্রত্যেকটা উড্ডয়ন পালককে একটা ক্ষুদ্র ডানার মতো কাজ করতে সক্ষম করে। এ ছাড়া, আপনি যদি একটা বড় আকৃতির উড্ডয়ন পালককে আরও কাছ থেকে দেখেন, তা হলে আপনি র্যাকিসের ভিতরের দিক বরাবর এক খাঁজকাটা অংশ দেখতে পাবেন। এই সরল নকশা শ্যাফটকে শক্ত করে আর এরজন্যই এটাকে না পেঁচিয়েই বাঁকানো বা মোচড়ানো যেতে পারে।
পালকের বিভিন্ন ভূমিকা রয়েছে
অনেক পাখির কনট্যুর পালকগুলোর মধ্যে লম্বা, সরু পালক ছড়িয়ে রয়েছে, যেগুলোকে ফাইলোপ্লুম পালক এবং পাউডার পালক বলা হয়। মনে করা হয় যে, ফাইলোপ্লুম পালকের গোড়ায় যে-সংবেদনশীল স্নায়ু রয়েছে, সেগুলো পাখির বহিঃস্থ পালকে সৃষ্টি হওয়া যেকোনো ধরনের বাধার বিষয়ে পাখিকে সতর্ক করে ও এমনকি বাতাসের মধ্যে পাখিকে তার
গতি নির্ণয় করতে সাহায্য করে। পাউডার পালকের বার্বগুলো—একমাত্র পালক, যেগুলো ক্রমাগত জন্মাতে থাকে কিন্তু কখনো খসে পড়ে না, সেগুলো—এক মিহি পাউডারে পরিণত হয়ে পাখির পালকে ছড়িয়ে পালককে জলরোধী হয়ে উঠতে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়।এ ছাড়া, পালকের অন্যান্য ভূমিকার মধ্যে রয়েছে এগুলো পাখিকে উত্তাপ, ঠাণ্ডা এবং অতিবেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, সামুদ্রিক হাঁস সাগরের তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস সত্ত্বেও সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে বলে মনে হয়। কীভাবে? তাদের ঠাসা কনট্যুর পালকের আবরণের নীচে এক নরম, তুলতুলে পালকের ঘন স্তর রয়েছে, যেগুলোকে ডাউন পালক বলা হয়। এই পালকগুলো প্রায় ১.৭ সেন্টিমিটার পুরু হয় এবং হাঁসের শরীরের বেশির ভাগ অংশকে ঢেকে রাখে। এই ডাউন পালকগুলোর মধ্যে সহজাত যে-অন্তরক গুণ রয়েছে, তা এতটাই কার্যকর যে, কোনো কৃত্রিম উপাদান এখনও এর সমতুল্য হয়নি।
পাখির পালকগুলো শেষপর্যন্ত জীর্ণ হয়, তাই পাখিরা সেগুলোকে খসিয়ে ফেলে—পুরনো পালকগুলো ঝরে পড়ে এবং সেই জায়গায় নতুন পালক জন্মায়। অধিকাংশ পাখি এক নির্দিষ্ট সময়ে ও ভারসাম্যপূর্ণ উপায়ে তাদের ডানা ও পুচ্ছ পালকগুলো খসিয়ে থাকে, যাতে তাদের ওড়ার ক্ষমতায় কোনো বাধা না পড়ে।
“একেবারে নিখুঁত”
নিরাপদ বিমানগুলো যত্নশীল নকশা, প্রকৌশলবিদ্যা এবং কারিগরিদক্ষতার কাজ। পাখি এবং এর পালকগুলো সম্বন্ধে কী বলা যায়? পালকগুলো কীভাবে উৎপত্তি হয়েছে, সেই বিষয়ের কোনো জীবাশ্ম প্রমাণ না থাকায় বিবর্তনবাদীদের মধ্যে প্রচণ্ড মতবিরোধ রয়েছে। “মৌলবাদী অনুভূতি,” “তিক্ত নামে ডাকা” এবং “জীবাশ্ম বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল অনুরাগ” এই বিতর্ককে প্রসারিত করেছে, সায়েন্স নিউজ পত্রিকা বলে। একজন বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী, যিনি পালকের বিবর্তনের বিষয়ে এক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছিলেন, তিনি স্বীকার করেছিলেন: “আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি যে, কোনো বৈজ্ঞানিক বিষয় এই ধরনের অশোভন মনোভাব এবং তিক্ততা সৃষ্টি করতে পারে।” স্পষ্টতই, পালক যদি বিবর্তিত হয়েই থাকে, তা হলে এই প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা কেন এত তিক্ততার বিষয় হবে?
“পালকগুলো একেবারে নিখুঁত—আর এটাই সমস্যা,” ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানুয়াল অভ্ ওরনিথোলজি— এভিয়ান স্ট্রাকচার আ্যন্ড ফাংশন উল্লেখ করে। পালকগুলো এমন কোনো ইঙ্গিত দেয় না যে, এগুলোর মধ্যে কখনো কোনো উন্নতির প্রয়োজন হয়েছে। বস্তুতপক্ষে, “জানা মতে, প্রথম দিকের জীবাশ্ম পালক দেখতে এতটাই আধুনিক যে, বর্তমানে উড্ডীয়মান পাখির পালকগুলোর চেয়ে এদের কোনোভাবেই পার্থক্য করা যায় না।” * তবুও, বিবর্তনবাদ শিক্ষা দেয় যে, নিশ্চয়ই শুরুর দিকে পাখির চামড়ায় সৃষ্ট স্ফীত অংশ থেকে পালকগুলো ধীরে ধীরে, ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনগুলোর ফলে গজিয়েছে। অধিকন্তু, “পালকগুলো সমস্ত মধ্যবর্তী ধাপে কিছু যুক্তিসংগত অভিযোজক মূল্য ছাড়া বিবর্তিত হতে পারে না,” সেই ম্যানুয়েল বলে।
সহজ কথায় বললে, এমনকি বিবর্তনবাদ অনুসারে পালকের গঠনে দীর্ঘসময় ধরে ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকা এই দ্রুততর ও বংশানুক্রমিকভাবে পরিবর্তনের প্রত্যেকটা ধাপ সংগঠিত না হলে একটা পালক অস্তিত্বে আসতে পারত না। এমনকি অনেক বিবর্তনবাদী ব্যক্তি এটাকে অসম্ভব বলে মনে করে যে, এত জটিল এবং নিখুঁতভাবে বিন্যস্ত পালক এভাবে উদ্ভূত হতে পারে।
অধিকন্তু, পালকগুলো যদি এক দীর্ঘসময় ধরে ধীরে ধীরে গঠিত হতো, তা হলে জীবাশ্ম নথিতে এর মধ্যবর্তী গঠনগুলো থাকা উচিত ছিল। কিন্তু, কেউই এই বিষয়ে কিছু খুঁজে পায়নি, কেবলমাত্র পূর্ণ গঠনের পালকগুলোই খুঁজে পেয়েছে। “দুঃখের বিষয়টা হচ্ছে, পালকগুলো এত জটিল যে, এদের প্রতি বিবর্তনবাদ প্রযোজ্য নয়,” সেই ম্যানুয়েল বলে।
পাখির ওড়ার জন্য পালকের চেয়ে আরও বেশি কিছু দরকার
পাখির পালকের নিখুঁত গঠনই বিবর্তনবাদীদের জন্য একটা সমস্যা, কারণ বলতে গেলে পাখির প্রত্যেকটা অংশই এর ওড়ার জন্য নকশা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একটা পাখির নিজের ডানা ঝাঁপটানো ও সেটা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হালকা, ফাঁপা অস্থি ও সেইসঙ্গে কর্মক্ষম শ্বসনতন্ত্র এবং বিশেষ মাংসপেশী রয়েছে। এমনকি এর প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা পালকের অবস্থান নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশ কিছু মাংসপেশী রয়েছে। আর এর অনেক স্নায়ু রয়েছে যেগুলো প্রত্যেকটা মাংসপেশীকে পাখির অত্যন্ত ক্ষুদ্র অথচ বিস্ময়কর মস্তিষ্কের সঙ্গে যুক্ত করে, যা যুগপৎভাবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে এবং নির্ভুলভাবে সমস্ত প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আগে থেকে পরিকল্পনা করা থাকে। হ্যাঁ, ওড়ার জন্য শুধুমাত্র পালক নয় বরং এইসমস্ত অবিশ্বাস্য রকমের জটিল অংশেরও প্রয়োজন।
এটাও মনে রাখবেন যে, প্রত্যেকটা পাখি এক ক্ষুদ্র কোষ থেকে বৃদ্ধি পায়, যেটার মধ্যে এর বৃদ্ধির ও সহজাত প্রবৃত্তির সম্পূর্ণ নির্দেশনা থাকে, যাতে একদিন এটা উড়তে শুরু করতে পারে। দীর্ঘসময় ধরে ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলা এই ধরনের আকস্মিক ঘটনাচক্রের দ্বারা কি এইসমস্ত কিছু আসতে পারে? নাকি সরল ব্যাখ্যা ও সেইসঙ্গে যুক্তিযুক্ত এবং বিজ্ঞানসম্মত এক ব্যাখ্যা রয়েছে, যেটা হল পাখি এবং এদের পালকগুলো অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন নির্মাতার বিষয় স্পষ্ট কিছু জানায়? প্রমাণ নির্মাতার পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়।—রোমীয় ১:২০. (g ৭/০৭)
[পাদটীকা]
^ জীবাশ্ম পালক নেওয়া হয়েছে আর্কিওপটেরিক্স নামে এক অধুনালুপ্ত প্রাণী থেকে, যেটাকে আধুনিক পাখিদের বংশধারায় এক “মিসিং লিংক” (বিবর্তনের ধারায় অন্তর্ভুক্ত এক লুপ্ত রূপ) হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু, অধিকাংশ জীবাশ্মবিদ এটাকে আর আধুনিক পাখিদের পূর্বরূপ বলে বিবেচনা করে না।
[২৪ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
নকল “প্রমাণ”
কিছু জীবাশ্ম “প্রমাণ,” যেগুলোকে একসময় এই প্রমাণ হিসেবে খুব জোরালোভাবে সমর্থন করা হতো যে, পাখিরা অন্য কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে, সেগুলো পরে নকল বলে তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে, ১৯৯৯ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকা এমন একটা জীবাশ্মের বিষয়ে একটি প্রবন্ধ তুলে ধরেছে, যে-প্রাণীটার পালক ছিল এবং ডাইনোসরের মতো একটা লেজ ছিল। এই পত্রিকা সেই প্রাণীটাকে “জটিল ধারায় এক মিসিং লিংক (বিবর্তনের ধারায় অন্তর্ভুক্ত একটি লুপ্ত রূপ)” হিসেবে ঘোষণা করেছে, “যা ডাইনোসর এবং পাখির মধ্যবর্তী লিংক।” কিন্তু, সেই জীবাশ্ম নকল প্রমাণিত হয়েছে, যা দুটো ভিন্ন প্রাণীর যৌথ জীবাশ্ম বলেই প্রমাণিত হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে, এই ধরনের কোনো “মিসিং লিংক” কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
[সৌজন্যে]
O. Louis Mazzatenta/National Geographic Image Collection
[২৫ পৃষ্ঠার বাক্স]
একটা পাখির চোখ দিয়ে দেখা
পাখির পালকের বিভিন্ন উজ্জ্বল এবং প্রায়ই বর্ণাঢ্য রং মানুষকে মুগ্ধ করে। কিন্তু, অন্যান্য পাখির কাছে পালকগুলো হয়তো আরও বেশি আগ্রহজনক হতে পারে। কিছু কিছু পাখির চোখের গঠনে চার রকমের রং নির্ণয়ের কোষ রয়েছে, যেখানে মানুষের রয়েছে মাত্র তিনরকম। দেখার জন্য এই অতিরিক্ত উপাদান এই পাখিগুলোকে অতিবেগুনি রশ্মি প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম করে, যা মানুষের কাছে অদৃশ্য। মানুষের কাছে কিছু প্রজাতির পুরুষ ও স্ত্রী পাখিকে দেখতে একইরকম মনে হয় কিন্তু অতিবেগুনি রশ্মি স্ত্রী পাখির পালকের চেয়ে পুরুষ পাখির পালকে ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়। এই পার্থক্য পাখিরা নির্ণয় করতে পারে, যা হয়তো তাদেরকে সম্ভাব্য সঙ্গীকে শনাক্ত করতে সাহায্য করে।
[২৩ পৃষ্ঠার ডায়াগ্রাম]
(পুরোপুরি ফরম্যাট করা টেক্সটের জন্য এই প্রকাশনা দেখুন)
বার্ব
বার্বিউল
র্যাকিস
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
কনট্যুর পালক
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
ফাইলোপ্লুম
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
পাউডার পালক
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
ডাউন পালক
[২৪, ২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
বড় সামুদ্রিক পাখি